নীরবতা,একাকীত্ব, প্রকৃতি ও নিসর্গ মানুষের
মনের দরোজা খুলে দেয় ।
শহর থেকে দূরে এমন এক নিভৃত নিসর্গের মাঝে, নীল জলরাশি, ঝর্ণা, পাহাড় আর
সামুদ্রিক মুক্ত হাওয়ায় নরওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে পাহাড় চূড়ায় একা নির্জন এক কুটিরে বসে
বিংশ শতকের সেরা অস্ট্রিয়ার দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন তাঁর দার্শনিক রচনা
"ট্র্যাকট্যাটাস লজিকো ফিলোসফিকাস" (1922) শেষ করেন।
এটি লেখা শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
সেনাছাউনিতে, পরে যুদ্ধবন্দী অবস্থায়। এ্যারোনটিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার, ক্যামব্রিজে বার্ট্রান্ড রাসেলের ছাত্র এবং
বন্ধু ভিটগেনস্টাইন (১৮৮৯--১৯৫১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ
দিয়েছিলেন।
ভ্যাকেশনে ক্যামব্রিজ থেকে নরওয়েতে তিনি প্রথম
আসেন ১৯১৩ সালে।বেড়ানোর জন্য বেছে নেন একটি দুর্গম জনবিরল পার্বত্য গ্রাম
জোলডেন।এখানে তিনি একটি ছোট ঘর তৈরি করেন।এখান থেকে তিনি রাসেলকে এক চিঠিতে জানান
যে, এখানে থেকেই তিনি লজিক্যল ম্যাথম্যাটিকসের সমাধান পাবেন।
দ্বিতীয়বার এখানে আসেন ১৯৩৬-৩৭ সালে। এবার
এখানে লিখলেন,"ফিলোসপিক্যাল ইনভেস্টিগেশন"। যা তার
মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। ৬২ বছরের
জীবনে তাঁর একটি মাত্র বই ট্র্যাকট্যাটাস প্রকাশিত হয়।
এক বই এখনো দার্শনিকদের ঘোরের মধ্যে রেখেছে।এই
বইয়ে ভাষা ও বাস্তবতা এবং বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে লজিক্যাল ভিত্তি তুলে ধরেন।
জোলডেনের স্থানীয় লোকেরা পাহাড় চূড়ায়
ভিটগেনস্টাইন কুড়ে ঘরটির নাম দিয়েছিল অস্ট্রিয়া হাউস।এই ঘরটি সংস্কার করে ২০১৮
সালে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।এটি এখন দার্শনিকের তীর্থভূমিতে পরিণত
হয়েছে।
ট্র্যাকট্যাটাস লেখার পরে দার্শনিক
শোপেনহাওয়ারের ভাবশিষ্য ভিটগেনস্টাইন ভাবলেন তাঁর অনুসন্ধান শেষ হয়নি,তিনি
ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, জোলডেনের স্হানীয় লোকেরা বলেছেন, ভিটগেনস্টাইন
কখনো কখনো ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টায় ওই ঘর থেকে বের হতেন না।
তার লেখার টেবিল থেকে বহুদূর পর্যন্ত নীল জলের
লেক, ঝর্ণা, আকাশ দেখা
যেত।রাত্রিতে তারকা দেখতেন আর অন্ধকার নিস্তব্ধতায় ডুবে থাকতেন।
জোলডেনে ভিটগেনস্টাইনের অবস্থান আমাকে
তিউনিশিয়ার পলিম্যাথ, সুফি ও কবি আবু সাইদ ইবনে খালিফ ইবনে ইয়াহিয়া
আল তামিম আল বাজির কথা স্মরণ করে দেয়, যিনি থাকতেন ভূমধ্যসাগর
উপকূলে নির্জন পার্বত্য এলাকায়,সেখানে তার শিষ্যরা আসতেন তার কাছে জ্ঞান
আহরণে।তিনি পাহাড়ের নির্জন আশ্রয় থেকে সমুদ্রে মিশে যাওয়া আকাশের দিগন্ত দেখতে
পেতেন। তিনি স্থানীয়দের কাছে সিদি বোয়া সাইদ নামে পরিচিত ছিলেন।এই নামেই আজো ওই
এলাকাটির নাম চালু আছে এবং এই নামেই এটি এখন তিউনিসিয়ার আকর্ষণীয় পর্যটন নগরী।
ফরাসী লেখক গুস্তাভ ফ্লেভার এই এলাকার নিসর্গের
বর্ণনা দিয়েছেন।ফরাসী কবি লরনাড গ্যাসপার (ডি এইচ লরেন্স, রিলকে এবং
জর্জ সেফেরিস অনুবাদক) দীর্ঘ সময় সিটি বোয়া সাইদে কাটিয়েছেন। গ্যাসপার এ নিয়ে
"লিভিং বোয়া সাইদ" নামে বই লিখেছেন।
ছবিঃ নরওয়ের জোলডেন গ্রামে পাহাড় চূড়ায়
ভিটগেনস্টাইনের লেখার টেবিল।
লেখক : মুহম্মদ আবদুল বাতেন
0 comments: